অনেকটা বেকায়দা সময়ে মারা গেলেন জোহরা বেগম। ঠিক মাগরিবের নামাজের পর পর। একে তো গ্রাম, তার উপর আবার শীতকাল। সন্ধ্যা হতেই চারদিকে অন্ধকার হয়ে যায়। সাথে তীব্র শীত।
পলা পড়লো ভীষণ বিপদে। ঘরে বলতে গেলে পলা একাই। বিধবা জোহরা বেগমের চার সন্তানের কেও এখানে থাকে না।
এখন এই মৃত বাড়িতে পলার এক মাত্র সঙ্গী হলো তুতু।
তুতু ওর পোষা কুকুর।
তুতুকে বসিয়ে রেখে পলা গেলো
প্রতিবেশিদের খবর দিতে।
মায়ের মৃত্যু সংবাদ পেয়েই রওনা দিয়েছে জবা। জবা জোহরা বেগমের বড় মেয়ে। পাশের গ্রামেই জবার শ্বশুরবাড়ি। এত কাছে থাকে জবা। তবু বিধবা মা'কে দেখতে আসার সময় হয় নাই এতদিন!
জোহরা বেগমের আরেক মেয়ে বকুল। থাকে জেলা শহরে। সে সাত দিনের পোয়াতি।
যদিও বকুলের স্বামী তাকে যেতে বলেছিলো! কিন্তু বকুল বাজখাই গলায় প্রতিবাদ করেছে
--এই অবস্থায় আমি কিভাবে যাই মরা বাড়িতে? যদি বাচ্চার অমঙ্গল হয়?
এই বলে কাঁদতে থাকে বকুল। বকুলের স্বামী আর দেবর আসবে মাটি দিতে।
জোহরা বেগমের ছোট মেয়ে পারুল। ইঞ্জিনিয়ার স্বামীর সাথে সে সিরাজগঞ্জ থাকে।
এখন ডিসেম্বর মাস তাই সামনে ছেলেদের বার্ষিক পরীক্ষা। অনিচ্ছা সত্বেও স্বামীসহ রওনা দিয়েছে পারুল। দিনাজপুরে আসতে আসতে তার অনেক রাত হবে।
সবাইকে ফোন দিয়ে পলা শেষে ফোন দেয় ছোটনকে। জোহরা বেগমের আদরের ছেলে ছোটন। ছোটন ঢাকায় থাকে। অনেক বড় চাকরি করে ছোটন।
--তুমি রাইতের ট্রেন ধইরা চইলা আসো ছোটন। না হইলে ছোট আম্মারে মাটি দিতে পারবা না।
এই বলে ঝরঝর করে কেঁদেছিল পলা।
এরপর আর একটিবারের জন্য কাঁদে নি পলা। আসলে কান্নার সুযোগটাই বা পেলো কোথায় সে?
এক হাতে সবকিছু করছে পলা। দাফন, কাফন, জানাজা আয়োজন সবকিছু।
তাই মড়া বাড়ির মড়া কান্নায় গতি আসে না।
অবশেষে জবা আসাতে কিছুটা রক্ষা। জবা মেয়েলি কান্নায় মড়া বাড়ির পরিবেশ ভারী করে রাখলো।
পলা একটা হ্যাজাক বাতি ভাড়া করে উঠানে ঝুলিয়ে দিল। হ্যাজাকের আলোতে আলোকিত হল জোহরা বেগমের বসতবাটি।
বাড়ির দুই দিকে প্রাচীরের মত টানা বাংলাঘর। পেছনে রান্না ঘর। দেউড়িতে দুইটি অশ্বথ গাছ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির সামনে একটা পুরোনো খানকা ঘর।
খানকা ঘরে মুসুল্লিরা জরো হয়েছে। বড় হুজুর পলাকে বললেন,
--কখন দাফন করবা ঠিক করলা কিছু পলা? আরো রাত করলে কবর দেয়ার মত মুসুল্লি পাওয়া যাবে না।
--ছোট আম্মার শেষ ইচ্ছা ছিলো ছোটন কে দেখবে। ছোটন আসার আগে লাশ দাফন করি কেমনে হুজুর? মাঝরাতের ট্রেনে ছোটন আসবে।
--সবই আল্লার ইচ্ছা। কাল বাদ ফজর মুর্দার মাটি হবে।
হুজুরের এক ঘোষনায় খানকাঘর খালি হয়ে গেলো। বাড়ির ভেতরে যে প্রতিবেশী দুইএকজন মহিলা ছিলেন তারাও চলে গেলেন।
জোহরা বেগমের খাটিয়াটি রাখা হয়েছে বাংলা ঘরের বারান্দায়।
পলা, জবা আর শেফালির স্বামী থাকলো লাশ পাহারায়।
কিছুক্ষণ আগে জবা'ও চলে গেলো কোন এক অযুহাতে।
জবা চলে যেতেই মরা বাড়ির মরা কান্না একেবারে থেমে গেলো। সারাবাড়ি যেন নিশ্চুপ নির্জন হয়ে আছে।
একটু আগে স্টেশনের ঘড়িতে রাত বারোটার বেল বাজলো।
ঢং ঢং ঢং।
এখন বারান্দায় লাশ নিয়ে বসে আছে পলা আর বকুলের স্বামী। বকুলের স্বামীর চোখ ঘুমে ঢুলুঢুলু করছে।
বকুলের দেবরকে বাংলা ঘরে শুতে দেয়া হয়েছে। বকুলের স্বামীকেও পলা বলেছিলো শুয়ে পড়তে।
বকুলের স্বামী বলেছিলো
--লাশ বাইরে রেখে কিসের ঘুম পালা ভাই? দেখতে দেখতেই সকাল হয়ে যাবে।
কিন্তু কিছুক্ষণ আগে পলা একটু জোড়াজুড়ি করতেই বাংলা ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছে বকুলের স্বামী।
পলা এখন একা। সবাই চলে যাওয়াতে পলার অবশ্য খারাপ লাগছে না।
একটু পর দেউড়িতে কিসের যেন শব্দ শুনতে পায় পলা।
গলা খাকড়ি দিয়ে পলা বলে - ছোটন আইলা?
না, ছোটনের কোন সাড়া পাওয়া যায় না।
তার পরিবর্তে তুতুর ঘেও ঘেও শব্দ কানে আসে। দেওড়ি পেড়িয়ে দুটি জ্বলজ্বলে চোখ এগিয়ে এসে আশ্রয় নেয় পলার কোলে। পলা পুরোনো কাশ্মীরী শালটা জড়িয়ে দেয় তুতুর গায়ে।
এই অনাহুত দুটো প্রাণী আজ এ বাড়ির আপনার চেয়েও আপন হয়ে উঠেছে।
তুতু পলার পাশে বসে লেজ নাড়াতে থাকে। কি এক অব্যক্ত কথার তাড়নায় কুই কুই করতে থাকে তুতু।
রান্নাঘর থেকে খড়ের বিচালি এনে আগুন জ্বালায় পলা। আগুনের ওম নিতে থেকে ওরা দুটি প্রানী। নীলগঞ্জে এবার যেনো শীত অনেক বেশি পড়েছে!
সেবারো অনেক শীত পড়েছিলো। যেদিন পলা এ বাড়িতে এসেছিলো।
খালি পায়ে কাঁপতে কাঁপতে কখন যে এ বাড়ির চৌহদ্দীতে পা দিয়েছিলো পলা, আজো তা মনে করতে পারে না।
সকালে যখন জোহরা বেগম ওকে পেলেন তখন ওর হাত ভর্তি ছিলো কুড়ানো শিউলী ফুল। পা খালি। নাক ভর্তি সিনকি।
সাথে ছিলো একটি কুকুর ছানা। তুতুর দাদার দাদা হবে হয়তো!
জোহরা বেগম পলাকে জিজ্ঞেস করলেন,
- এই ছেলে তুই কে রে? কই থাইকা আইলি? নাম কি তোর?
পলা পিটপিট করে শুধু তাকিয়ে ছিলো জোহরা বেগমের দিকে। আর বলেছিলো..
- আম্মা, আম্মা। আম্মার কাছে যাবো।
বাজা বৌ জোহরা বেগম একটানে বুকে তুলে নিয়েছিলেন।
সেদিন থেকে আজ অব্দি পলা এ বাড়িতেই রয়ে গেলো।
পালক ছেলে বলে নাম হলো পলা। এরপর বছর ছয় ঘুরতেই বাজা জোহরা বেগম মা হলেন। একে একে ঘরে এলো তিন মেয়ে আর এক ছেলে।
ততদিনে জোহরা বেগমের আদরে পলা তার নিজের মায়ের কথা ভুলে গেছে।
জোহরা বেগমের ছেলে-মেয়েরা বড় হতে থাকে। একদিন হুট করে মারা যায় জোহরা বেগমের স্বামী। সংসারের জোয়াল এসে পলার কাঁধে অনিবার্যভাবে আশ্রয় নেয়। আর সংসার পাতা হয় না পলার।
পলার প্রতি এহেন অবিচারে জোহরা বেগমের বুক কাঁপে। কোন এক নির্জন বিকেলে হয়তো পলা বসে থাকে জোহরা বেগমের শিয়রের কাছে।
জোহরা বেগম বলেন,
--তুই আমাকে মাফ করে দিস পলা। আমি তোর প্রতি অবিচার করেছি।
--ছি ছোট আম্মা।
-- আমি তরে দশ কানি জমি লিখে দিলাম পলা। আমি তরে বিয়া দিমু। এই জমিতে তুই নতুন সংসার পাতবি।
-- আমি জমি দিয়ে কি করবো ছোট আম্মা? আপনি তো আছেন। আমার আর কিছু লাগবে না ছোট আম্মা।
- তোর আম্মা কি আমার চেয়েও তরে বেশি সোহাগ করতো রে পলা?
পলা এ কথার কোন উত্তর খুঁজে দেখে নি।
তবু বিষন্ন কোন সন্ধ্যায় পলার চোখে নিজের মায়ের মুখটা যেনো ভেসে উঠে। নোলকপড়া গাঁয়ের বধু শুধু পলাকে ডেকে যায়।
সে গাঁয়ের ঠিকানা পলা জানে না। শুধু জানে সেই গ্রামে সকালে সূর্য্য উঠে, পাখি ডাকে। আর নোলকপড়া বধুটা পলাকে সোহাগ করে কোলে তুলে নেয়। যার বুক জুড়ে আছে সর্ষে ফুলের হলুদ ঘ্রাণ। সে নোলক দুলিয়ে পলাকে ডাকে....আয়-আয়-আয়।
কিন্তু পলা যেতে পারে না জোহরা বেগমের মায়া ছিঁড়ে।
হুম, আজ রাতেও পলা জোহরা বেগমকে রেখে শুতে যেতে পারে নি। জোহরা বেগমের লাশ নিয়ে বারান্দায় বসে থাকে সে।
একটুপরে খানকা ঘরের সামনে
বড় মাইক্রোবাস এসে দাঁড়ায়। ঘেউ ঘেউ করে বাইরে বেরিয়ে আসে তুতু।
পারুল এসে নামে বাড়িতে।
মায়ের মুখ দেখে কাঁদতে থাকে পারুল। পারুলের কান্নায় এই মাঝরাতে কেমন একটা ঘোর লাগে পলার।
তবে একসময় পারুলের হিসেবি কান্নাও শেষ হয়ে যায়।
চোখ মুছে বলে
--তোমাদের জামাই উপজেলার ডাকবাংলো বুকিং করেছে। আজ রাতে তোমাদের জামাই দুই বাচ্চা নিয়ে ওখানেই থাকবে।
পলা নিচু স্বরে বলে
--তুমিও যাও পারুল।
--কিন্তু?
--কিন্তু আর কি পারুল? আমি আছি তো!
এই বলে পলা ওদেরকে আবার গাড়িতে তুলে দিলো।
ভেতর বাড়িতে এসে হ্যাজাকের গ্যাস পাম্প করে পলা আবার বসলো খাটিয়ার পাশে।
বসে বসে তন্দ্রা মত হলো পলার। পলা যেনো দাঁড়িয়ে আছে ছাতিম গাছটার নিচে। হাতে কুড়ানো শিউলি ফুল। সাথে একটা কুকুর ছানা। আম্মা আম্মা করে সমানে কেঁদে চলছে পলা। নোলকপড়া গ্রাম্য মহিলাটা যেনো একটানে বুকে তুলে নিতে চায় পলাকে।
আয়-আয়-আয়.....
এসময় হুইসেলের শব্দে তন্দা কাটে পলার। শেষ রাতের ট্রেন এসে লাগে স্টেশনে। পলার বুকটা হু হু করে উঠে।
আরো কিছুক্ষণ পর খানকা ঘরের পেছনে রিকশার টুংটাং শব্দ শোনা যায়।
--ছোটন এলি?
খানকা ঘরের সামনে একটা রিকশা দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু হ্যারিকেনের টিমটিমে আলোয় আরোহীকে চিনতে পারে না পলা।
--আপনি কে?
--আমি মাসুদ আলী। জহীরুল ইসলাম স্যার আমাকে পাঠিয়েছেন।
--কে? জহীরুল? আমাদের ছোটন?
--জি। আসলে, স্যার একটা জরুরি কাজের জন্য আসতে পারেন নি।
--কী বললেন! ছোটন আসে নাই?
-না। এই খামটা রাখেন। বিশ হাজার টাকা আছে।
--টাকা?
--স্যার দিয়েছেন খালাম্মার কুলখানির জন্য। তিনি বলেছেন সময় পেলেই কবর জিয়ারত করতে আসবেন।
পলার চোখে আবার পানি এলো। নিজেকে সামলে নিলো সে। টাকাগুলো ফিরিয়ে দিয়ে লোকটাকে বাংলা ঘরে শুতে দিলো।
আবার লাশের পাশে এসে বসে পলা।
কিছুক্ষণ পর ফজরের আযান হল। জানাজা শেষে কবর দেয়া হলো জোহরা বেগমকে।
সবাই কবরে মাটি দিয়ে চলে গেল। জোহরা বেগম তার রক্তের কারো হাতের মাটি পেলেন না।
মাটি শেষে দেউড়ির শিউলি তলায় এসে দাঁড়ায় পলা।
আনমনে শিউলি ফুলে মুঠি ভরে ফেলে সে। লেজ নাড়তে নাড়তে পাশে এসে দাঁড়ায় তুতু।
এ যেনো সেই সকাল। সেই ভোর। সেই শিউলি ফুল হাতে ছোট্ট পলা। শুধু মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে পলার জীবনের অনেকটা সময়।
কিন্তু আজ পলাকে কোলে তুলে নেবার জন্য জোহরা বেগম নেই!
শুধু নোলকপড়া গ্রামের বধূটা সুদূর থেকে যেন ডেকে যায় পলাকে,
.....আয় - আয় - আয়
পলা-ও যেন স্পষ্ট সেই ডাক শুনতে পায়।
বাংলাঘরের দেউড়ি পেড়িয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসে পলা। তুতু পেছন পেছন পলাকে অনুসরণ করে।
জোহরা বেগমের উঠোনে পড়ে থাকে শিশির ভেঁজা শিউলি ফুল আর ছেড়া দলিলের কতক টুকরো।
লেখকঃ রাজীব উল আহসান
রচনাকালঃ ২০ নভেম্বর ১৯