জেষ্ঠ প্রতিবেদক, আমিনুল ইসলাম তন্ময়:চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার সীমান্ত ঘেঁষা ইউনিয়ন আলাতুলি ইউনিয়ন হেরোইন পাচারের এক স্বর্গরাজ্য। বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়ন-বিজিবি চোখ ফাঁকিয়ে দিয়ে ভারত থেকে প্রতিনিয়ত দেশে আসছে হেরোইনসহ বিভিন্ন মাদক দ্রব্য। গডফাদার রয়ে যাচ্ছে মুলত ধরাছোঁয়ার বাইরে। মিথ্যা প্রলোভনে সাধাণ মানুষকে মাদক পাচার করাচ্ছে গডফাদার জনপ্রতিনিধি জামাল হোসেন সেন্টু(সেন্টু মেম্বার)। তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের নির্বাচিত মেম্বার। ত্ার খপ্পরে পড়েছে সর্বশান্ত অনেক পরিবার। তাঁর মাদক পাচার ব্যবসার প্রলোভনে পড়ে আইন-শৃংখলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়ে আদালতে দরিদ্র যুবক শরিফুল ইসলামের ফাঁসির রায় হয়েছে। তিনি এখন রাজশাহী কারাগারে রয়েছেন । সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে সেন্টু মেম্বারের নায্য বিচার দাবী করেছে এলাকাবাসী। তার নাম আদালতে বললে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকিও দেয়া হচ্ছে ভুক্তভোগীদের।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার ভারত সীমান্ত ঘেঁষা ইউনিয়ন আলাতুলী। জেলা সদর থেকে চরাঞ্চলের সুন্দরপুর, চরবাগডাঙ্গা, দেবীনগর তিনটি ইউনিয়ন পেরিয়ে আলাতুলী যেতে পদ্মা ও শাখা পদ্মা নদী অতিক্রম করতে দিন শেষ হয়ে যায়। প্রেক্ষিতে সড়ক পথে যেতে হয়, রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার মহিশালবাড়ি হয়ে পদ্মা নদীর ঘাটে। পদ্মা নদী পেরিয়ে রাজশাহী জেলার চরআষাঢ়িয়াদহ ইউনিয়নের ৮/৯ কিলোমিটার ধু-ধু বালুচরে একমাত্র বাহন ভাড়ায় চলাচলকারী মটরসাইকেল। অতঃপর বিদ্যুৎহীন উপজেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জের আলাতুলী।
চরাঞ্চল সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দুর্গম চরাঞ্চল আলাতুলী ইউনিয়নের কোদালকাটি-জেলেপাড়া গ্রামের মহসিন আলী মেয়ে রানী খাতুন(৩২)। ২০০৩ জেল হাজতে থাকা তার নিকট আত্মীয়কে ঢাকায় দেখতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে পথিমধ্যে তার কাছে থাকা ব্যাগ পাল্টিয়ে নেয় হেরোইন পাচারের গটফাদার স্বশিক্ষিত জামাল হোসেন সেন্টু মেম্বার। তিনি আলাতুলী ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের পর-পর নির্বাচিত দ্বিতীয়বারের মেম্বার। এরপর রানী খাতুনকে রাজশাহীর রাজাবাড়ি চেকপোস্টে মাদকদ্রব্য হেরোইনসহ আটক করে পুলিশ। কৌশলে সেন্টুর পাল্টিয়ে নেয়া ব্যাগে হেরোইন ছিল ৩’শ গ্রাম । তার ব্যাগ তল্লাশী করে পাওয়া যায় হেরোইন । এক বছর জেলে থাকার পর আদালতের মাধ্যমে জামিনে বের হয়ে দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে আদালতে নিয়মিত হাজিরা দিয়ে আসছেন রানী। মামলার আইনজীবী রানীকে জানিয়েছেন, আাগামী যে কোন হাজিরায় তার মৃত্যুদÐ কিংবা যাবজ্জীবন কারাদন্ড হতে পারে। এতে মামলা চালাতে বড় অংকের টাকার প্রয়োজন তার। কিশোরী বয়সে মামলা হওয়ার কারণ রানীর এখনও বিয়ে হয়নি। সেন্টু মেম্বারের ফাঁদে পড়ে সে এখন সর্বশান্ত হয়ে পড়েছেন। শুধু জেল হাজতেই শেষ নয়, সেন্টু মেম্বারের নাম আদালতে বলা হলে তাকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকীও দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন রানী ও তাঁ মা। মেয়ের এমন অসহনীয় ঘটনার বিচার চেয়েছেন রানীর প্যরালাইসিসে আক্রান্ত বৃদ্ধা মা জাহানারা বেগম। তিনি জানান, সেন্টু আমাদের সব শেষ করে দিয়েছে, আমি তার বিচার চাই।
রানীর জীবনের করুণ কাহিনী শেষ না হতে আর একজন ভুক্তভোগী সন্ধান পাওয়া যায়। তিনি একই গ্রামের জয়নাল আবেদিনের ছেলে শরিফুল ইসলাম। হেরোইন বহন করে পাচার মামলার রায়ে মৃত্যদন্ড প্রাপ্ত আসামী শরিফুল। তিনি বর্তমানে রাজশাহী করাগারে বন্দি রয়েছেন। শরিফুলের বাবা জয়নাল আবেদীন জানান, তার ছেলেকে ২০১২ সালের কোন এক সকলে জমিতে যাওয়ার নাম করে সীমান্তের দিকে ডেকে নিয়ে যায় জামাল হোসেন সেন্টু মেম্বার। পরে শরিফুলকে সাথে নিয়ে সীমান্তের দিক থেকে একটি ব্যাগে হেরোইন নিয়ে আসছিলেন সেন্টু মেম্বার। পথে বিজিবি’র কাছে ধরা পড়লে আমার ছেলে শরিফুলের হাতে একটা ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে সেন্টু বিজিবি’র সাথে ধস্তাধস্তি করে পালিয়ে যায়। এ সময় ব্যাগ তল্লাশী করে আমার ছেলে শরিফুলকে ৩৭টি প্যাকেটে তিন কেজি সাত’শ গ্রাম হেরোইনসহ গ্রেফতার করে বিজিবি। ওই মামলায় ২০১৭ সালে শরিফুলকে মৃত্যুদন্ডের রায় দেয় রাজশাহীর একটি আদালত। তবে এখনও রায় কার্যকর হয়নি। বাবা শরিফুল ইসলাম জানান, আমরা দিনমজুর; গরিব-অসহায় মানুষ, কোন আইনজীবী নিয়োগ করতে পারিনি। ছেলের মৃত্যুদন্ড রায় শুনে পাগল প্রায় অবস্থায় মা ফিরোজা বেগম। তিনি ছেলে শরিফুল ইসলামের মুক্তির দাবি করেন।
শুধু রানী বা শারিফুল নয়, এমন অসংখ্য এলাকাবাসী অভিযোগ করেন জামাল হোসেন সেন্টু মেম্বারের বিরুদ্ধে। ফজলুর রহমান নামে আর এক বৃদ্ধ জানান, তিন বছর আগে ছেলে জয়নাল আবেদিন ও নিকট আত্মীয় সুলতানের ছেলে কালুকে ২ হাজার টাকার লোভ দেখিয়ে সেন্টু মেম্বার রাজশাহী পাঠিয়েছিলেন, হেরোইন পাচার করতে। সে সময় পুলিশের হাতে ধরা পড়লে দীর্ঘদিন জেলে থাকার পর আমার ছেলে জামিনে বেরিয়ে আসে।
কারও সাথে শত্রæতা বা বিরোধ হলে তাকে বিভিন্ন কৌশলে মাদক দিয়ে ফাঁসিয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে হেরোইন গডফাদার সেন্টু মেম্বারের বিরুদ্ধে। আলাতুলী ইউনিয়নে কোদলকাটি জেলেপাড়া গ্রামের নারগিস বেগম জানান, কিছুদিন পুর্বে তার স্বামী শফিকুল ইসলামকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। পরে জানতে পারি তাকে হেরোইন ব্যবসায় পলাতক আসামি করা হয়েছে। তবে মামলার এফআইআর এতে নাম না থাকলেও রহস্যজনক ভাবে চার্জশিটে নাম রয়েছে শফিকুল ইসলামে। এমন গোলকধাঁধা থেকে বেরিয়ে আসা তো দুরের কথা, কিছু বুঝতে পারছে না শফিকুলের পরিবার। এমন গায়েবী মাদক মামলায় গ্রামের কয়েকজন জেলহাজতে রয়েছে বলে জানা গেছে। এমন অভিযোগও করেন কারাগারে বন্দি শফিকুল ইসলামের স্ত্রী জেলেপাড়ার নার্গিস বেগম ও তার কিশোরী মেয়ে রিমা।
এ সব ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে আলাতুলী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক মেম্বার ও চেয়ারম্যান প্রার্থী এবং স্থানীয় মোড়ল ইসরাইল হোসেন জানান, সীমান্তবর্তী আলাতুলী এলাকায় বহু পুর্ব থেকেই হেরোইন পাচারের অধিক্য রয়েছে। এতে প্রায় মানুষ মিথ্যা মামলাসহ বিভিন্ন ভাবে হয়রান হচ্ছেন। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীকে শাস্তির আওতায় নেয়া জরুরী।। না হলে গ্রামের সাধারণ মানুষের দুর্দশা আরও বাড়বে বলে মনে করেন তিনি।
বন্দি শফিকুল ইসালামে ভাই কৃষক রফিকুল ইসালাম জানান, আমার ছোট ভাই দিনমজুর ও কৃষিজীবী। ভাই ভাল মানুষ। তার কোন শত্রæ ছিল না। তারপরও গায়েবী মামলায় ভাইকে জেলে আটকে রাখা হয়েছে।
আলাতুধী ইউনিয়নের শান্তিপাড়া এলাকার সদ্য বিবাহিত আলিম জানালেন, তিনি সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় ঘাস কাটছিলেন, এ সময় সেন্টু মেম্বারের আত্মীয় বাবুল টাকার প্রলোভন দিলে তার সঙ্গে তিনি একটি ব্যাগ নিয়ে হাঁটার সময় বিজিবি’র হাতে ধরা পড়েন। পরে তিনি আদালত থেকে জামিনে বের হন। তার বিরুদ্ধে হেরোইন মামলা চলছে আদালতে।
এ বিষয়ে আলাতুলী ইউনিয়ন পরিষদের ৮ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য জামাল হোসেন সেন্টু (সেন্টু মেম্বার) ক্যামরার সামনে কোন আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেননি(গোপন ক্যামেরায় তোলা ভিডিও ফুটেজ ও ছবি সংরক্ষিত রয়েছে)। তবে আকপটে মাদক ব্যবসার কথা শিকার করে তিনি বলেন, আগে হেরোইন ব্যবসা করতাম, এখন আর করি না। রানি, শারিফুল ও জয়নালদের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে মাদকদ্রব্য হেরোইন স¤্রাট সেন্টু জানান, গ্রামে একদল মানুষ তাঁর ক্ষতি করার চেষ্টা করছে।
পদ্মা নদী ভাঙ্গণ কবলিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার আলাতুলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন অকপটে জানান, ওই সীমান্তের অধিকাংশ মানুষই হেরোইন পাচার ব্যবসার সংগে জড়িত। এর বাইরে হাতে গোনা ২/১ জন ছাড়া স্থানীয় জন প্রতিনিধিরাও জড়িত।
এদিকে, মাদকদ্রব্য হেরোইন ব্যবসায়ীর বিপক্ষে গিয়ে প্রতিবেদককে সহযোগীতা করায় আলাতুলী ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড ভাড়পাড়ার আসাদুল হক রনির উপর আক্রমনাত্মক হয়েছেন মাদক স¤্রাট সেন্টু মেম্বার। তার ভয়ে ভীত হয়ে রনি বর্তমানে স্ত্রী ও ২ ছোট শিশু কন্যাকে সন্তান নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার মহিশালবাড়ি এলাকায় স্বজনের বাড়িতে।
পদ্মা নদী ভাঙ্গণ কবলিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার আলাতুলী ইউয়নে মুলত কোন পাকা দালান বাড়ি চোখে পড়বে না। শান্তিপাড়া, ভাড়পাড়া, মাষ্টারপাড়া, গোলাপাড়া, নিচাপাড়া, চরকোদালকাটি, গাইনাপাড়া, ডাঙ্গাপাড়াসহ সীমান্ত ঘেঁষা আলাতুলী ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম এলাকা ঘুরেও পাতা-দালানবাড়ি দেখা যায়নি। শুধু মাত্র শান্তিপাড়ায় রয়েছে কোদালকাটি সরকারী প্রাথমিক ও মাধ্যমিকসহ দু’টি দালান ভবন। এ বিষয়টি নিয়ে একাধিক ব্যাক্তির সংগে আলাপে জানান যায় এলাকাটি মুলত নদী ভাঙ্গণ কবলিত এবং দুর্গম চরাঞ্চল। পদ্মার গ্রাসের ছিন্নভিন্ন আলাতুলী ইউনিয়ন।
তবে অন্য সুত্রগুলো জানিয়েছে, যোগাযোগ বিছিন্ন দুর্গম এলাকায় স্থানীয় অধিবাসীরা বাড়ি তৈরী না করলেও অধিকাংশের বহুতল ভবনের আলিসান বাড়ি রয়েছে, রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী, তানোর ও মহিশালবাড়ি এলাকায়। কারো-কারো দালান বাড়ি রয়েছে, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। গোদাগাড়ী এলাকাটিকে দেখে বিস্মিত হতে হয়, আলিসান দালানকোঠার কারণে যদিও গোদাগাড়ী শহরটি রাজশাহীর একটি উপজেলা শহর।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানার পরিদর্শক (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) মোজাফর হোসেন অকপটে জানালেন আলাতুলী সীমান্তে হেরোইন নামের মাদক ব্যবসা হচ্ছে। এর জন্য সীমান্তে রয়েছে বিজিবি। এর পাশাপাশি পুলিশ, র্যাব ও ডিবি পুলিশের পাশাপাশি মাদক পাচার রোধে নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছে বিভিন্ন আইন-শৃংখলা বাহিনী। পাচারকারী অভিযু দেরকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়া হচ্ছে। যার কারণে ওই সীমান্তে মাদক পাচার তুলনামুলক ভাবে হ্রাস পেয়েছে। এলাকার সাধারণ নাগরিক হয়রান ও হেরোইন বাহকরা মামলায় জড়িত; এমন এক প্রশ্নে পুলিশ পরিদর্শক জানান, এ ধরণের কোন অভিযোগ থানায় কেউ করেনি। লিখিত অভিযোগ পেলে আইনী কঠর ব্যবস্থা নেয়া হবে।