এম.এস.হোসেন:
৭ মার্চ, ১৯৭১। বাঙালির ইতিহাসের একটি অবিস্মরণীয় দিন। এদিন ‘রেসকোর্স ময়দানে’ দাঁড়িয়ে ১০ লাখ মানুষের সামনে যে ভাষণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিয়েছেন সেটি ছিল শোষিত, বঞ্চিত এবং নিপীড়িত মানুষের মুক্তির দলিল।
পৃথিবীর ইতিহাসে ১৮ মিনিটের এ ভাষণটি একটি অদ্বিতীয় ভাষণ হিসেবে বিবেচিত হয়। কারণ এই ভাষণ ২৩ বছরের বঞ্চিত, অবহেলিত ও শোষিত বাঙালিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করে।
বঙ্গবন্ধুর জীবন-সংগ্রামের প্রতিটি অধ্যায়ের প্রতিটি পাতায় জড়িয়ে আছেন তার সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। শুধু কি বঙ্গবন্ধুর জীবন সংগ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন বঙ্গমাতা? না, বঙ্গমাতা জড়িয়ে আছেন ৫২ থেকে ৭১ পর্যন্ত বাঙালির প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামের সঙ্গে।
পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ ৭১ এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন, যে ভাষণ বুকে নিয়ে নিরস্ত্র বাঙালি সশস্ত্র হয়েছিল, রক্ত দিয়ে স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে এনেছিল। কেমন ছিল সেই ভাষণ দেয়ার প্রেক্ষাপট? কি ভূমিকা ছিল সেখানে বঙ্গমাতার?
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার স্মৃতিচারণমূলক এক বক্তব্যে পাওয়া গেছে এর উত্তর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন ‘জনসভায় যাওয়ার কিছুক্ষণ আগে আব্বা (শেখ মুজিব) কাপড় পরে তৈরি হবেন, মা আব্বাকে নিয়ে ঘরে এলেন। দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে আব্বাকে বললেন ১৫ মিনিট চুপচাপ শুয়ে থাকার জন্য। আমি আব্বার মাথার কাছে বসে মাথা টিপে দিচ্ছিলাম।’
তিনি বলেন, ‘মা বেতের মোড়াটা টেনে আব্বার কাছে বসলেন। যেকোনো বড় সভায় বা গুরুত্বপূর্ণ কাজে যাওয়ার আগে আমার মা আব্বাকে কিছুক্ষণ একদম নিরিবিলি রাখতেন। মা আব্বাকে বললেন, সমগ্র দেশের মানুষ তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তোমার মনে যে কথা আসে তুমি তাই বলবে। অনেকে অনেক কথা বলতে বলেছে। তোমার কথার ওপর সামনের অগণিত মানুষের ভাগ্য জড়িত।
প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যের মাঝেই পাওয়া যায় ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণে মূল প্রেরণা ও সাহস যুগিয়েছিলেন বঙ্গমাতা। এ ভাষণের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর জীবন-সংগ্রামে আর কিভাবে ভূমিকা রেখেছেন বঙ্গমাতা চলুন জেনে নেয়া যাক-
ফজিলাতুন্নেছার জন্ম ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট। তিন বছর বয়সেই হারান পিতা শেখ জহুরুল হককে আর পাঁচ বছর বয়সে মা হোসনে আরা বেগমকেও হারান তিনি। দাদা শেখ আবুল কাশেম ফজিলাতুন্নেছা ওরফে রেণুর চাচাতো ভাই শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার বিয়ে দেন। শেখ মুজিবের বয়স যখন ১৩ ও বেগম ফজিলাতুন্নেছার বয়স যখন মাত্র তিন, তখন পরিবারের বড়রা তাদের বিয়ে ঠিক করেন। ১৯৩৮ সালে বিয়ে হওয়ার সময় রেণুর বয়স ছিল ৮ বছর এবং শেখ মুজিবের ১৮ বছর।
কলকাতায় লেখাপড়া ও রাজনীতি করতেন বঙ্গবন্ধু, দফায় দফায় কারাবরণ করেছেন। এ নিয়ে কোন অভিযোগ ছিল না রেনুর। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘রেনু খুব কষ্ট করত, কিন্তু কিছুই বলতো না। নিজে কষ্ট করে আমার জন্য টাকা পয়সা জোগাড় করে রাখত। যাতে আমার কষ্ট না হয়।’
বঙ্গবন্ধু যখন নিপীড়িত মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য গ্রামান্তরে ঘুরছেন, কারাবরণ করছেন তখন শুধু পরিবার না বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ঢাল সামলে রেখেছেন বঙ্গমাতা। সন্তানদের লেখাপড়া হউক কিংবা গ্রেফতার বঙ্গবন্ধুর জন্য আইনজীবী নিয়োগ। মামলা চালানোর খরচ, কোর্টে যাওয়া, নিজে রান্না করে কারাগারে নিয়ে যাওয়া, সাক্ষাতের সময় সব কিছু পুঙ্খানুপুঙ্খ জানিয়ে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কাছে পৌঁছে দিয়ে তা কার্যকর করতেন।
৫৪ সালের ১০ মার্চ, প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিজয়ী হয়, বঙ্গবন্ধু সদস্য নির্বাচিত হন। টুঙ্গি পাড়া থেকে বঙ্গমাতা ছেলেমেয়েদের নিয়ে ঢাকায় আসলেন, রজনী বোস লেনে একটি ভাড়া বাড়িতে বসবাস শুরু করলেন। ১৫ মে, বঙ্গবন্ধু কৃষি উন্নয়ন, বন ও সমবায়মন্ত্রী নিযুক্ত হন। ৩০ মে, পাকিস্তান সরকার পূর্ববাংলা মন্ত্রিসভা বাতিল করে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে।
কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে দিলে ৫৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু কোয়ালিশন সরকারের শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতি দমন ও ভিলেজ এইড দফতরে মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। মন্ত্রীর চেয়ে দলের দায়িত্বকে প্রাধান্য দিয়ে স্বেচ্ছায় মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দল গোছাতে মনোযোগ দিলেন বঙ্গবন্ধু। এই নিয়ে কোন অনুযোগ ছিলো না বঙ্গমাতার। হাসি মুখে স্বামীর সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছেন। জানা যায়, স্ত্রীর অনুপ্রেরণাতেই মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দল গোছাতে মনোযোগ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।
আইয়ুব খান ৫৮ সালের ৭ অক্টোবর সামরিক শাসন জারি করে সংসদ ভেঙে দিলে ১২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হন। সেখান থেকে শুরু বঙ্গমাতার সংগ্রাম। কারাগারে স্বামী, কেউ দিতে চাইছে না বাড়ি ভাড়া, তিন দিনের নোটিশে সন্তানদের নিয়ে বাড়ি ছাড়তে হলেও তিনি অটল থেকেছেন।
এ প্রসঙ্গে কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন, লড়াই, সংগ্রামে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত এসেছে, কিন্তু কখনো মাকে ভেঙে পড়তে দেখিনি। যতো কষ্টই হোক আমার বাবাকে কখনোই বলেননি যে তুমি রাজনীতি ছেড়ে দাও বা সংসার কর বা খরচ দাও। আব্বা যে পদক্ষেপ নিতেন সেটাকেই সমর্থন করতেন তিনি।’
ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর বাড়ি নির্মাণে বঙ্গমাতা,
ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর বাড়ি নির্মাণ করেন নিজের জমানো টাকা ও আবাসন ঋণ নিয়ে। এ প্রসঙ্গে বেবী মওদুদ ‘মহীয়সী নারী বেগম ফজিলাতুন্নেছা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘সব কাজ নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তদারকি করতেন। খরচ বাঁচানোর জন্য নিজের হাতে পানি দেয়া, ইট ভেজানোসহ বহু শ্রম, যত্ন ও মমতা দিয়ে বত্রিশ নম্বরের বাড়িটি নির্মাণ করেন।’
আব্দুল গাফফার চৌধুরীর ‘ধীরে বহে মেঘনা’ গ্রন্থে জেলাখানায় স্বামীকে লেখা বঙ্গমাতার একটি চিঠির অংশ দেখা যায়, ‘আপনি শুধু আমার স্বামী হওয়ার জন্য জন্ম নেননি, দেশের কাজ করার জন্যও জন্ম নিয়েছেন, দেশের কাজই আপনার সবচেয়ে বড় কাজ, আপনি নিশ্চিত মনে সেই কাজে যান, আমার জন্য চিন্তা করবেন না।’
ছয় দফা বাস্তবায়নে বঙ্গমাতা,
তৎকালীন ছয় দফা বাস্তবায়ন নিয়ে নানা বিতর্ক শুরু হয়। কেননা বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা ঘোষণা করেন ৬৬ এর ৫ ফেব্রুয়ারি। সে বছর ৮ মে, নারায়ণগঞ্জে ছয় দফার সমর্থনে জনসভা করে ঘরে ফেরার পর গভীর রাতে গ্রেফতার হন তিনি। ওই সময় ছয় দফা না আট দফা বিভ্রান্তিতে অনেক নেতাও আট দফার পক্ষে কথা বলেন। ছয় দফা থেকে একচুলও নড়া যাবে না- বঙ্গবন্ধুর এই নির্দেশ বাস্তবায়নে বঙ্গমাতা ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখেন। ছয় দফার সমর্থনে বোরকা পরে জনসংযোগ করেন তিনি।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা,
৬৮ সালের ৩ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ও চৌত্রিশ নেতার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হলে সেখানেও বঙ্গমাতা তার দূরদর্শিতা দেখিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু কোথায় আছেন, বেঁচে আছেন কিনা এই খবর অজানা ছিল। সেনাবাহিনীর এক ক্যাপ্টেন বঙ্গমাতাকে জিজ্ঞাসাবাদে কোন তথ্য না পেয়ে হুমকি দেয় প্রয়োজনে বঙ্গমাতাকে গ্রেফতার করা হবে। তিনি ভয় পাওয়ার মানুষ নন। ওই সময় প্রতি বন্দি পরিবারের নিয়মিত খোঁজ-খবর নেন ও সহযোগিতা করেন এবং মামলা পরিচালনার জন্য প্রবাসী বাঙালিদের সহায়তায় লন্ডন থেকে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী স্যার টমাস উইলিয়ামকে ঢাকায় নিয়ে আসেন।
প্যারোলে মুক্তিতে বঙ্গমাতার বাধা,
লেখক সৈয়দ বদরুল আহসান ‘ফ্রম রেবেল টু ফাউন্ডিং ফাদার: শেখ মুজিবুর রহমান’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন- তিনি (বঙ্গমাতা) বঙ্গবন্ধুর কাছে বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন- মুজিব তার সহধর্মিনীর কথা শুনেছিলেন। প্যারোলে মুক্তি নিয়ে কোন চিন্তাই তিনি আর করেনি।
বঙ্গমাতার দূরদর্শিতা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথ খুলে দিয়েছিল। শেখ হাসিনার উদ্ধৃতি, ‘পাকিস্তান সরকার আম্মাকে ভয় দেখায়, বঙ্গবন্ধু প্যারোলে মুক্তি না নিলে তিনি বিধবা হবেন। মা সোজা বলে দিলেন, কোন প্যারোলে মুক্তি হবে না। নিঃশর্ত মুক্তি না দিলে কোন মুক্তি হবে না। আমি মায়ের সিদ্ধান্তের কথা বঙ্গবন্ধুকে যখন জানালাম তখন অনেক আওয়ামী লীগ নেতাকেও দেখেছি আমাকে বলতে, তুমি কেমন মেয়ে? বাবার মুক্তি চাও না? আম্মাকে বলেছে, ভাবী আপনি কিন্তু বিধবা হবেন।’
২৫ শে মার্চ ও বঙ্গমাতা,
৭১ এর ২৫ শে মার্চ বত্রিশ নম্বর বাড়ি আক্রমণ করে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা, বঙ্গমাতা ছেলে-মেয়ে নিয়ে প্রথমে পাশের বাসায় আশ্রয় নেন। বত্রিশ নম্বর বাড়ি তছনছ করে, টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর মা বাবার সামনে বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেয়। বড় ছেলে শেখ কামাল ২৫ মার্চ রাতেই মুক্তিযুদ্ধে যান, আটক অবস্থায় শেখ জামালও যান।
উনিশ বার জায়গা বদল করেও রেহাই পেলেন না, একদিন মগবাজারের বাড়ি থেকে ছেলে-মেয়েসহ বঙ্গমাতাকে গ্রেফতার করে ধানমন্ডির ১৮ নম্বর রোডের একটি বাড়িতে রাখে পাকসেনারা, বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন কিনা জানতেন না। বন্দি অবস্থায় কন্যা শেখ হাসিনার সন্তান জন্ম নেয়ার সময় তাকে একবারের জন্যও ঢাকা মেডিকেলে যেতে দেয়া হয়নি।
শেখ রেহানা ‘একজন আদর্শ মায়ের প্রতিকৃতি’ লেখায় এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘জুলাই মাসের শেষ দিকে হাসু আপা হাসপাতালে গেল। মা যাওয়ার জন্য তৈরি হয়েও যেতে পারলেন না। সৈন্যরা তাকে যেতে দিল না। বলল, ‘তুমি কি নার্স না ডাক্তার যে সেখানে যাবে’ মা খুব কষ্ট পেয়ে সারারাত কেঁদেছিলেন।’ বন্দি অবস্থায় তিনি অসুস্থ শ্বশুর-শাশুড়ির চিকিৎসার ব্যবস্থা করান তৎকালীন পিজি হাসপাতালে (যা বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়), সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন, খবরাখবর আদান প্রদান করতেন।
অসামাপ্ত আত্মজীবনী,
বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীমূলক বই অসামাপ্ত আত্মজীবনী লিখার পেছনেও বঙ্গমাতাই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করেছেন। বঙ্গমাতাই বঙ্গবন্ধুকে উদ্ভূদ্ধ করেছেন বইটি লিখতে। জাতির পিতার আত্মজীবনীর প্রায় ১৪টি পৃষ্ঠায় তার স্ত্রীর ভূমিকা তুলে ধরেন। এমন কি বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী আজকে আমাদের মাঝে আসার পেছনের কারণটাও তিনি।