ডিএম কপোত নবী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ : মিঠুন দিনমজুরি করে ১০ মণ ধান পেয়েছিলেন। সেই ধান ইঞ্জিন চালিত ভ্যানে করে বাড়ি ফিরছিলেন। কাছাকাছি চলেও এসেছিলেন। কিন্তু এরপর ইঞ্জিন চালিত ভ্যানটি উল্টে যায়। সেই ধানের বস্তার নিচেই চাপা পড়েন তারা। ধান নয়, বাড়ি আসে তাদের মরদেহ।
মিঠুনের স্ত্রী তাজরিন জানান, বুধবার রাতে মোবাইলে বলেছিল ধান কাটা শেষ, ১০ মণ ধান পেয়েছি। সব ধান একসাথে নিয়ে আসছি, তুমি একটা ভ্যান ঠিক করে রাখিও যাতে করে রাস্তা থেকে বাড়ি পর্যন্ত ধান নিয়ে যেতে পারি।
ভোরে আবার তাজরিনের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করেন মিঠুন। জানিয়ে ছিলেন, বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছেন ভ্যানটা নিয়ে আসতে। কিন্তু এর কিছুক্ষণ পরই তাজরিন জানতে পারেন ভ্যান উল্টে তার স্বামী ও শ্বশুর তোজাম্মেল হকসহ ৯ জন শ্রমিক মারা গেছেন। আহত হয়েছেন আরও কয়েক জন শ্রমিক। তারা সবাই ধানের বস্তার ওপর বসেছিলেন।
মিঠুনের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার সোনামসজিদের কাছেই বালিয়া দিঘি গ্রামের কলোনি পাড়ায়। ২১ দিন আগে বাবার সঙ্গে ধান কাটতে গিয়েছিলেন নওগাঁ।
দুপুরে ধান নয়, বাড়িতে আনা হয় মিঠুন ও তার বাবার মরদেহ। কান্নায় ভেঙে পড়েন মিঠুনের মা সানোয়ারা বেগম ও তার দাদিসহ স্বজনরা।
মিঠুনরা এতটা গরিব যে, তাদের বাড়িতে দুটি মরদেহ রাখা এবং মরদেহ দেখতে আসা মানুষের সংকুলান হবে না। এ কারণে মরদেহ দুটি প্রতিবেশীর বাড়িতে রাখা হয়।
মিঠুনের বাবার মামা কামাল উদ্দীন বলেন, মিঠুনের বাড়িতে লাশ রাখা যাবে না তাই এখানে পাশের বাড়িতে রেখেছি। যাতে লাশ সবাই দেখতে পারে।
এই দুর্ঘটনায় নিহত ৯ জনের মধ্যে ৭ জনের বাড়ি বালিয়াদিঘি গ্রামে। এই গ্রামের বাসিন্দা তামিম হোসেন বলেন, একসঙ্গে তাদের গ্রামে এর আগে এত মানুষের মৃত্যু কেউ দেখেননি। এ ঘটনায় গ্রামের মানুষেরা শোকে বোবা হয়ে গেছেন।
এদিকে এ দুর্ঘটনায় আহত আলিম হোসেনের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, তাকে স্যালাইন দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, তারা ১৫ জন শ্রমিক। রাত দু’টার দিকে নওগাঁর নিয়ামতপুর থেকে ধান নিয়ে ইঞ্জিন চালিত ভ্যানে করে বাড়ি ফিরছিলেন। তিনি বসেছিলেন চালকের পাশে। বারিক বাজারের কাছে ভাঙাচুরা রাস্তায় ইঞ্জিন চালিত ভ্যানটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশে খাদে পড়ে যায়।উপরে যারা বসে ছিলেন, তারা সবাই ধানের বস্তার নিচে চাপা পড়েন।
এদিকে দীর্ঘদিন ভাঙ্গাচুরা রাস্তাটি মেরামতে উদ্যোগ নেননি ইউপি চেয়ারম্যান। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বক্সার আলী নামের এক জন বাসিন্দা বলেন, আমরা গ্রামবাসী অনেকবার বলেছি চেয়ারম্যান দুগাড়ি খুয়া ফেলেনি, যদি রাস্তাটা একটু ভাল করত তাহলে এতগুলা মানুষ নাও মরতে পারত।
শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাকিব আল রাব্বি জানান, নিহত প্রত্যেক শ্রমিকের পরিবারকে তাৎক্ষণিকভাবে ১০ হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছে।
স্বামীর সঙ্গে সুমি আক্তারের শেষ কথা হয় বুধবার রাতে। ধান নিয়ে সকালে বাড়ি পৌঁছার কথা। কিন্তু মোবাইলে রিং করে সেটি বন্ধ পান। এরপর খবর পান বাড়ি থেকে প্রায় ২ কিলোমিটার দূরে ভ্যান উল্টে গেছে। অনেক শ্রমিক হতাহত হয়েছেন। পাগলের মতো ছুটে যান সুমি। ততক্ষণে তার স্বামীকে হামিদুল হককে ধানের বস্তার নিচে থেকে উদ্ধার করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
হামিদুলসহ ২ জনকে উদ্ধার করে প্রথমে নেয়া হয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে তাদের রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। হামিদুলদের চিকিৎসা চলছে হাসপাতালের ৮ নম্বর ওয়ার্ডে। স্বামীর পাশেই মেঝেতে বসেছিলেন সুমি। তিনি জানান, তাদের ২ শিশু সন্তান রয়েছে।
হামিদুলের পাশেই আরেক আহত আব্দুল লতিপের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তার পাশে বসে আছেন স্ত্রী নাহার বেগম ও ছেলে আকাশ ইসলাম। আকাশ বলেন, তার বাবাকে অজ্ঞান অবস্থায় বস্তার নিচ থেকে উদ্ধার করা হয়। এখনও জ্ঞান ফেরেনি।
রাজশাহী মেডিকেল হাসপাতালের উপ-পরিচালক সাইফুল ফেরদৌস জানান, ২ জনের অবস্থাই কিছুটা আশঙ্কাজনক। এদিকে সোনামসজিদ বধ্যভূমি এলাকায় নিহতদের দাফন সম্পন্ন হয়েছে।
উল্লেখ্য, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার দাইপুকুরিয়া ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বারিক বাজার এলাকায় বৃহস্পতিবার ভোর সাড়ে ৪ টার দিকে ইঞ্জিন চালিত ধান বোঝাই ভ্যান উল্টে ৯ জন ধানকাটা শ্রমিক নিহত হয়েছে। আহত হয় আরও কয়েকজন শ্রমিক। এ ঘটনায় চাঁপাইনবাবগঞ্জে শোকের ছায়া নেমে আসে।